
সম্পাদকীয়:
কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী জগতি চিনিকল এক সময় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত এই চিনিকল শুধু কুষ্টিয়া জেলার অর্থনীতির চালিকাশক্তিই ছিল না, বরং এটি হাজারো শ্রমিক ও আখচাষীর জীবিকার উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আজ সেই কালের সাক্ষী, গৌরবময় জগতি চিনিকল নিঃশব্দে তার অপমৃত্যু বরণ করেছে—ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, রাজনৈতিক অবহেলা, এবং পরিকল্পনার অভাবে। এই বন্ধ হয়ে যাওয়া শুধু একটি কারখানার শাটার পড়া নয়, বরং একটি অঞ্চলিক অর্থনীতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এক অন্ধকার ছায়া।
চিনিকল বন্ধ হওয়ার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি, অনিয়ম ও আধুনিকায়নের অভাব মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা যেত। বরং লাভজনকভাবে পরিচালনার বদলে বছরের পর বছর লোকসান গুনে গুনে একে মৃতপ্রায় করে তোলা হয়েছে।
এর প্রভাব শুধু শ্রমিকদের জীবিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। আখচাষীরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কৃষি ভিত্তিক এই অঞ্চলের অর্থনীতি পড়েছে হুমকির মুখে। স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ী, পরিবহন কর্মী, এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের মানুষজনও হারিয়েছেন তাদের আয়ের উৎস।
জগতি চিনিকল ছিল শুধু একটি কল-কারখানা নয়—এটি ছিল একটি অঞ্চলিক ঐতিহ্য, একটি প্রজন্মের শ্রমঘাম মিশ্রিত ইতিহাস। এটি বন্ধ হওয়ার অর্থ হলো, আমরা শুধু একখণ্ড শিল্প হারাইনি, হারিয়েছি একটি সম্প্রদায়ের স্বপ্ন ও আত্মপরিচয়।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল এই ধরণের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ যখন আমরা ‘উন্নয়ন’ আর ‘ডিজিটালাইজেশন’-এর গর্বে আত্মমগ্ন, তখন এই ধ্বংস হওয়া চিনিকল আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়—উন্নয়নের নামে সব কিছু ধ্বংস করে দিলে সেটি উন্নয়ন নয়, আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
আমরা দাবি জানাই, সরকার অবিলম্বে জগতি চিনিকলের পুনর্জন্ম ও বিকল্প ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা, চাষীদের কথা এবং শ্রমিকদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে একটি টেকসই ও স্বচ্ছ সমাধান হোক। কেবল ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের স্বার্থেই এর পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন।