শৈশবে যে-সব খেলাধুলায় দিন কাটিয়েছেন আজকের বয়োবৃদ্ধরা, তারাও এখন ভুলতে বসেছেন সেসব খেলার নাম। এ দেশের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে ছিল কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা, তাস, লুডু, ফুটবল, হ্যান্ডবল, কাবাডি বা হাডুডু, লাটিম ইত্যাদি।
বাংলাদেশের ক্রিয়া জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ক্রিকেট এবং ফুটবল। ফুটবলে জাতীয়ভাবে আমাদের তেমন সাফল্য না থাকলেও ক্রিকেটে সাফল্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ এখন চেনে সাকিব-তামিমের মতো খেলোয়াড়দের পরিচয়ে।
তবে, এত প্রাপ্তির মধ্যে কোথায় যেন একটা আত্মতৃপ্তির স্বাদ নেই বলে মনে হয়। এত জনপ্রিয়তার মধ্যে হারিয়ে গেছে আমাদের গ্রামবাংলার এক সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কাবাডি বা হাডুডু।
এত সব জনপ্রিয় খেলার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় খেলা হাডুডু। প্রতিবছর স্কুল-কলেজগুলোতে বার্ষিক আন্তঃক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আর অধিকাংশ সময় দেখা যায় ক্রিকেট, ফুটবল অথবা ভলিবল টুর্নামেন্টের নাম। স্কুল কলেজ পর্যায়ে কোনো কাবাডি টুর্নামেন্ট অথবা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা নেই এবং করাও হয় না। একসময় গ্রামাঞ্চলের সকল ছেলে-মেয়ে এই খেলার সাথে পরিচিত ছিল। কিন্তু ফুটবল-ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার মাঝে এখন গ্রামেও সচরাচর হাডুডু খেলা দেখা যায় না।
এমনকি বর্তমানে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে স্বচক্ষে কখনো কাবাডি খেলা দেখেনি। অনেকে আবার এর নিয়ম সম্পর্কেই জানে না। পাঠ্যপুস্তকের শারীরিক শিক্ষা বইতে অনেকে প্রথমবারের মতো কাবাডি খেলার সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু আসলে কি এটি হওয়া উচিত? যেহেতু হাডুডু আমাদের জাতীয় খেলা, সেহেতু ছোটবেলায় থেকেই এই খেলার সাথে আমাদের পরিচিত হওয়া উচিত। এই খেলার সাথে অধিকাংশের পরিচিত না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে স্কুল-কলেজগুলোতে অন্যান্য টুর্নামেন্টের পাশাপাশি কাবাডি খেলার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে, ছেলেমেয়েরা কাবাডি খেলার প্রতি উৎসাহিত হচ্ছে না এবং খেলা সম্পর্কে কোনো ধারণাও তাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে না।
যদি স্কুল-কলেজগুলোতে কাবাডি খেলার ব্যবস্থা থাকে এবং প্রত্যেকটি স্কুল কলেজে বার্ষিক কাবাডি টুর্নামেন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে কাবাডির জনপ্রিয়তা তৈরি করা সম্ভব।
গ্রামের কিশোরদের হাডুডু খেলা নিয়ম অনুসারে, এক পরে একজন খেলোয়াড় অপর পরে কোর্টে হানা দেয়। এ সময় সে শ্র“তিগোচরভাবে হাডুডু, হাডুডু বা কাবাডি কাবাডি শব্দ করতে করতে অন্য পরে যেকোনো একজন খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ওই পরে চেষ্টা থাকে সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। যদি ওই খেলোয়াড় দম ধরে রেখে নিজ কোর্টে ফিরে আসতে পারে, তাহলে তার দল পয়েন্ট পায়। আর যদি আটকে থাকা সময়ের মধ্যে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে যায়, তাহলে বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়।
একসময় গ্রামাঞ্চলে হাডুডু খেলার খুব বেশি প্রচলন ছিল। সময়ের বিবর্তনে মানুষের ব্যস্ততা, আধুনিকায়নের ফলে খেলাটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কষ্টসাধ্য শারীরিক এ খেলা যুবসপ্রদায়কে আর টানে না। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে হাডুডু খেলা কি হারিয়ে যাচ্ছে?
আর সেই হারিয়ে যাওয়া এই হাডুডু বা কাবাডি খেলাকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি এই গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলার আয়োজন করে।
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২, বাংলার নতুন বছরকে বরণ করে নিতে কিশোরগঞ্জে, বৈশাখের প্রথম দিনে নানান আয়োজন দেখা যায় সকাল থেকেই। বাংলা নতুন বছরের এ বর্ষবরণকে আরও রঙিন করে তুলেছে জেলা বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী কাবাডি ম্যাচ।
ঐতিহ্যবাহী এ খেলা উপভোগ করতে আশপাশের কয়েক হাজার দর্শক মাঠের চারপাশের ভীড় জমানো। উপচেপড়া ভীড় দেখা গেছে পুরো খেলাজুড়ে।
ইটপাথরের এ নগরজীবনে শহরবাসীর মনে গ্রামীণ পরশ আর আনন্দ দিতে ও বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া এসব খেলাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এমন আয়োজন অব্যাহত থাকুক সব-সময়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ শরিফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেলসহ বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা।
এসময় কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ শরিফুল আলম বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা কাবাডি এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। কালের আবর্তনে এখন কাবাডি খেলা আর দেখা যায় না। তিনি আরো বলেন জনপ্রিয় এই কাবাডি খেলাটি সবার মাঝে টিকিয়ে রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফুটবল ক্রিকেটে যতটা সহজে ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব, কাবাডি খেলায় ক্যারিয়ার গঠন করা তেমনি কষ্টকর। এজন্য তরুণ প্রজন্ম আগ্রহী হচ্ছে না কাবাডি খেলার প্রতি। সরকারের উচিত এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাহলে একদিকে খেলোয়াড়রা যেমন উৎসাহিত হবে, তেমনি খেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে।
খেলা দেখতে আসা সানজিদ বলেন, 'ছোট বেলায় শুনতাম কাবাডি খেলা হতো। কিন্তু কখনো দেখার সুযোগ হয় নাই। শুধু শুনেই গেছি। আর এই খেলা যে কিভাবে খেলে তাও জানি না। কিন্তু আজকে শুনলাম আমাদের গুরুদয়াল কলেজ মাঠে এই কাভাডি খেলার আয়োজন করেছে। তাই খেলাটি সরাসরি দেখার ইচ্ছে ছিলো তাই কলেজ মাঠে এসে আজকে সরাসরি এই কাবাডি খেল দেখলাম। খেলাটি দেখতে পেয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে।
খেলা দেখতে আসা ৮০ বছরের বৃদ্ধ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এই কাবাডি অনেক খেলেছি। এখন শরীরে বল নেই। খেলা দেখতে এলাম। অনেক ভালো লেগেছে।’
এসময় লাল দল ও সবুজ দল কাবাডি খেলায় অংশ গ্রহণ করে। এতে লাল দল সবুজ দলকে হারিয়ে খেলায় বিজয়ী লাভ করে।
ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলা উপভোগ শেষে অতিথিবৃন্দ খেলোয়াড়দের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।